top of page
color logo shaded 01.png
... এক সাংস্কৃতিক পরিবার

পূর্ণত্বের পথ। *

(শ্রীমৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ)

 

আমাদের প্রত্যেক কর্ম্মোদ্যোগই কোন অভাবজাত এবং এই সচেতন কর্ম্মশীলতাই জীবন বা প্রাণ শক্তি নামে পরিচিত। কর্ম্মশীলতা সচেতন হইলেই আমরা তাহাকে প্রাণ বা জীবন বলি; কিন্তু বাষ্পীয় যান ও যন্ত্রের ন্যায় অচেতন হইলে আমরা উহাকে প্রাণ-শক্তি বলিয়া গণ্য করি না। আর প্রত্যেক কর্ম্মশীলতাই কোন না কোন অভাব প্রণোদিত। কিসে আমাকে কর্ম্মশীল করিয়াছে? – কোন বস্তুলাভের বাসনা। কেন তোমরা এখানে আসিয়াছ? – কারণ, তোমরা ভাবিয়াছ যে এখানে কোন প্রকার জ্ঞান বা সাহায্য লাভ করিবে। কিছু লাভ বা উপল্পব্ধি করিবার আশা না থাকিলে আমরা এক পদও অগ্রসর হই না। প্রত্যেক কর্ম্মোদ্যমের পূর্ব্বে চঞ্চলতা বর্ত্তমান ততক্ষন তোমার কর্ম্মশীল হইতেই হইবে, তুমি তোমার আন্তরিক অভাব পূর্ণ করিবার চেষ্টা করিবেই।

 

কিন্তু বাস্তবিক কি মানুষের কোন অভাব আছে? শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় মহান নরদেব এবং যীশুখৃষ্ট ও বুদ্ধের ন্যায় অবতারগণ অন্যরূপ শিক্ষা দিয়াছেন। তাঁহাদের মানবসংজ্ঞা অতি অদ্ভূত। তাঁহার বলেন, মানব জন্ম-মৃত্যু রহিত, অভাবশূন্য, আনন্দময়, স্বয়ম্ভূ ও স্বয়ং প্রকাশ। এমন কি শিবের ত্রিশূলেরও তাহাকে বিনষ্ট করিবার শক্তি নাই – সে স্বভাবতঃ নিত্য ও অবিনশ্বর। ইহাই যদি মানবের সংজ্ঞা হয় তবে আমি কি? আমিও ত মান নামে অভিহিত; কিন্তু আমি মাত্র সার্দ্ধত্রিহস্ত দীর্ঘ, আমি জন্মগ্রহণ করি, মৃত্যু মুখে পতিত হই, আমার বহু অভাব আছে! দীনতম শ্রমজীবী হইতে শ্রেষ্ট সম্রাট পর্য্যন্ত এমন একজনকেও কি দেখাইতে পার যে অভাবে পরিপূর্ণ নহে? মানুষ বাস্তবিকই অভাবগ্রস্থ জীব। যে মুহূর্ত্তে শিশু মাতৃগর্ভ হইতে নিষ্ক্রান্ত হয় সেই মুহূর্ত্তেই সে ক্রন্দন করে। -কেন? কারণ, সে অভাবগ্রস্ত। মানুষ জন্মে অভাবের মধ্যে, প্রাণ ধারণ করে অভাবের মধ্যে এবং অভাবেই সে মরে। অভাব হইতেই তাহার উদ্ভব, অভাবেই তাহার স্থিতি এবং অভাব হইতেই তাহার মৃত্যু।

তাহা হইলে ঐ দুই প্রকার মানবের মধ্যে কি সম্বন্ধ? কিরূপে একটী অপরটীর সমান হইতে পারে? কিরূপে একটী অন্যটীর সহিত একীভূত হইতে পারে? একটী সমস্ত অভাব-ভীতি ও জন্ম-মৃত্যুর অতীত, আর অপরটী সর্ব্বপ্রকার ভীতি ও বাসনা পরিপূর্ণ এবং জন্ম-মৃত্যুর অধীন। দৃষ্টতঃ দুই বিপরীত মেরুস্থিত এই দুই শ্রেণীর মানবের মধ্যে কোন সম্বন্ধ থাকা কিরূপে সম্ভব? তথাপি কিন্তু উহাদের সম্বন্ধ আছে। এই যে জন্মমৃত্যুবিশিষ্ট মানব, এই শান্ত ও পরিচ্ছিন্ন মানবই তাহার অনন্ত স্বরূপ নির্দ্দেশ করিতেছে। মানুষ সতত চঞ্চল, সর্ব্বদা স্থান হইতে স্থানান্তরে গতিশীল। - কেন? কারণ সে কখনও সন্তুষ্ট নহে, কারণ – কিছুই তাহাকে নিত্য সন্তোষ দিতে পারে না। আর সে যে তাহার সান্ত স্বভাবে সন্তুষ্ট নহে তাহাতেই বুঝা যায় যে, উহা তাহার প্রকৃত স্বরূপ নহে। তাহার অসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অদমনীয় ক্ষুধা থাকাতেই প্রমাণিত হয় যে সে স্বরীপতঃ অনন্ত এবং সেই জন্যই যাহা কিছু সান্ত তাহাতে সে সর্ব্বদা অপরিতৃপ্ত।

যে কোন ব্যক্তির নিকট যাও, দেখিবে যে সে তাহার সসীম অবস্থায় অতৃপ্ত। তোমাদের মধ্যে একজনও প্রকৃতপক্ষে পরিতুষ্ট নও। তুমি হয়ত বলিতে পার যে, তুমি তোমার মাসিক একশত টাকায় তুষ্ট, কিন্তু উহা আলস্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। আলস্যকে সন্তোষ বলিয়ে ভুল বুঝিও না। প্রকৃত সন্তোষ কি তাহা নচিকেতা আমাদিগকে দেখাইয়াছেন। যমরাজ তাঁহাকে প্রচুর ঐশ্বর্য্য, বিশাল রাজ্য ও সুন্দরী রমণী দিতে চাহিলেন, কিন্তু নচিকেতা জানিতেন যে একমাত্র সত্যই তাঁহাকে সুখী করিবে – তিনি অন্য কিছুই কামনা করেন নাই; কিন্তু যদি কেহ তোমাকে একশতের পরিবর্ত্তে দুইশত টাকা দিতে চাহেন তবে কি তুমি তাহা গ্রহণ করিবে না? ইহাতেই প্রতীয়মান হয় যে তোমার বর্ত্তমান অবস্থায় তুমি সন্তুষ্ট নও। যদি তুমি আত্মবিশ্লেষণ কর তাহা হইলে দেখিবে যে তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমা নাই। কখন তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেষ হইবে? যখন তুমি বলিতে পারিবে “আমি সকলের প্রভু, সমগ্র বিশ্ব আমার অধীন, আমার কোন অভাব নাই, আমি মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়াছি, আমার কোন দায়িত্ব নাই।” যতক্ষন না এই ভাব আসিবে ততক্ষন তোমার উচ্চাভিলাষ তোমায় ত্যাগ করিবে না। তুমি সসীমতা হইতে মুক্ত হইতে চাও, কিন্তু যতক্ষন না তুমি বলিতে পার যে, তুমি সীমা হীন, মৃত্যুশূন্য ও অবিনশ্বর ততক্ষন তুমি শান্ত হইতে পারিবে না।

ইহাকেই বলে মুক্তি বা মোক্ষ। অতএব এই ক্ষুদ্র মানব, সেই মহামানব সেই অনন্তপুরুষের সম্পূর্ণ বিপরীত বলিয়া বোধ হইলেও, যে পর্য্যন্ত এই ক্ষুদ্র মানব সেই অনন্তপুরুষের সহিত একীভূত না হয়, সে পর্য্যন্ত সে কখনই স্থির ও শান্ত হইবে না; ইহাতেই বুঝা যায় যে, অনন্তত্বই তাহার প্রকৃত স্বরূপ। যদি তুমি একটি মৎস লইয়া উহাকে ভারত সম্রাট সাজাহানের ময়ূরসিংহাসনে বসাও এবং তাহাকে প্রণাম ও পূজা কর তাহা হইলে সে কি সুখী হইবে? তাহা নহে, বরং সে বলিবে “ আমায় বরং একটি মলকুন্ডে নিক্ষেপ কর তবু যে জলের বাহিরে আমায় রাখিও না” কারণ, জলই (অপ) তাহার স্বাভাবিক আলয় তুমিও ঠিক ঐভাবেই তোমার নষ্ট স্বরূপের জন্য অস্থির।

এমন কেহই নাই যে চঞ্চল নহে। কিসে জন্য চঞ্চল? – তাহার নষ্টস্বভাব, তাহার অনন্ত স্বরূপ ফিরিয়া পাইবার জন্য। যে ব্যক্তি তাহার বর্ত্তমান (সসীম) অবস্থায় অতৃপ্ত সে ধন্য, যে তাহাতে পরিতৃপ্ত সেই মহা হতভাগ্য। ঐরূপ পরিতৃপ্ত ব্যক্তি মনুষ্য নামের যোগ্য নহে – সে পশুতুল্য। তুমি একটি হস্তীকে সারাজীবন বদ্ধ রাখিতে পার, কিছু আহার পাইলেই সে নিশ্চিন্ত। যাহারা ঐরূপে পরিতৃপ্ত তাহারা পশু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিসে? নীচ পশুর ন্যায় আমাদেরও আহার নিদ্রা ভয় মৈথুন আছে; সুতরাং যদি আমরা উহা অপেক্ষা উচ্চতর কিছু না করিতে পারি তবে পশু হইতে আমাদের পার্থক্য কোথায়?

যেখানে অসন্তোষ সেইখানেই জানিবে মহত্ত্বের বীজ নিহিত আছে। যে কোন মহাপুরুষের জীবনী পাঠ করিলে দেখিবে তিনি সতত কিরূপ কর্ম্মশীল ও চঞ্চল ছিলেন – সর্ব্বদা অধিকতর বস্তুলাভের জন্য সচেষ্ট। আর যে সকল আরামপ্রিয় লোকের কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাই, তাহারা কুলি হইবার জন্যই নির্দ্ধারিত। ইহারা ঠিক কলুর বলদের ন্যায়, সমস্তদিন ঘানির চারিদিকে ঘূরে, কখনও নির্দিষ্ট পথরেখা পরিত্যাগ করিতে পারে না। এই সকল ব্যক্তি যখন বিদ্যালয় ছিল তখন তাহারা শিক্ষায় যত্নবান ছিল না – নিজ নিজ শ্রেণীর সর্ব্বনিম্নপ্রান্তে থাকিয়াই সন্তুষ্ট ছিল’ আর উহাদের সহিত কতকগুলি ছিল শিক্ষার জন্য ব্যাকুল ও উচ্চাভিলাষী – তাহারাই এখন উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী, বর্ত্তমানে গণ্যমান্য বক্তি। মহাপুরুষগণের জীবনী পাঠ কর, দেখিবে তাঁহারা ব্যাকুল ও চঞ্চল ছিলেন বলিয়াই মহৎ হইয়াছিলেন। সুতরাং শ্রম-বিমুখ হইও না।

কখনও অল্পে সন্তুষ্ট থাকিও না। তুমি অসীম, তুমি পূর্ণ, এবং যতক্ষন না তুমি তোমার অনন্তস্বরূপ উপলব্ধি করিবে ততক্ষন ক্ষান্ত হইও না। মনে করিও না তোমার বুদ্ধিশক্তি সীমাবিশিষ্ট – সক্রেটীসের মস্তিষ্ক, নিউটনের ধীশক্তি তোমার ভিতে বর্ত্তমান। কেবল ধুলি ও আবর্জ্জনায় তাহা তুমি আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছ। ধৌত কর সেই ধুলিরাশি, জাগ্রত কর তোমার উচ্চাভিলাষ, উত্তেজিত কর তোমার কর্ম্মশক্তিকে, আর স্মরণ রাখিও যে অনন্ত শক্তি তোমার ভিতরে সুপ্ত আছে। তুমি সীমাবদ্ধ নও – কখনই না। যে সকল বরেণ্য সাধুপুরুষ জগদীশ্বর হইতে স্থান ও কাল দ্বারা অপরিচ্ছন্ন তাঁহাদের মতই তুমি সীমা হীন – অনন্ত।

আমাদের শাস্ত্রে আমাদিগকে শিক্ষা দিতেছে যে, কোন ব্যক্তিকে পাপী বলাই সর্ব্বাপেক্ষা মহাপাপ। যখনই তুমি নিজেকে পাপী ও দুর্ব্বল মনে কর তখনই তুমি তোমার অনন্তস্বরূপ ভুলিয়া গিয়া দেহ ও মনের শইত তোমার একত্ব বা তাদাত্ম্য স্থাপন কর। দেহ ও মনের সহিত আত্মার এই একত্বাজ্ঞানই, এই অদ্যাসই সকল দুঃখের মূল। যদি তোমার অনন্তস্বরূপ উপলব্ধি করিতে চাও তবে তোমার শান্ত স্বভাবের সহিত সকল সংশ্রব দূর কর, তোমার দেহ ও মন ভুলিয়া যাও। তোমার আত্মাকে দেহ ও মন হইতে বিচ্ছিন্ন কর। বস্তুতঃ তুমি সর্ব্বদাই উহা করিতেছ। তুমি কি সর্ব্বদা ভাব “আমি দীর্ঘ বা খর্ব্ব, আমি কৃষ্ণ বা গৌরবর্ণ, আমি ক্ষীণ বা স্থূল?” কেবল যখন কোন দর্পণের সম্মুখে দন্ডায়মান হও তখন ঐসকল ভাব তোমার মনে উদিত হয়। স্বাস্থ্য কাহাকে বলে? যখন মানুষের স্মরণ থাকে না যে সে দেহবিশিষ্ট, তখনই সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ। শীরঃপীড়া হইলেই তোমার স্মরণ হয় যে তোমার একটী মস্তক আছে। পায়ে যখন ব্যথা হয়, তখনই মনে হয় যে, তোমার পা আছে। তুমি চৈতন্যস্বরূপ, প্রাণস্বরূপ। দেহবুদ্ধির তোমাতে প্রতিষ্ঠালাভ করিলেও তোমাকে উহা (দেহ) বিস্মৃত হইতেই হইবে। যখন তুমি কোন সুন্দর দৃশ্য বা সুমধুর সঙ্গীত উপভোগ কর, তখন তুমি দেহ ভুলিয়া যাও; অর্থাৎ সেই সময়ের জন্য তুমি দেহাতীত। ইহাই তোমার সত্যস্বরূপ এবং সেইজন্যই তুমি সে সময় সুখী। যখন তুমি শান্ত স্থির চিন্তামগ্ন, তখন তুমি দেহ বিস্মৃত হও। আর যখন হঠাৎ কিছু আসিয়া তোমার সেই অবস্থারপ্রতিবন্ধক হয়, তখন তুমি উহাকে যাতনা বল।

চিন্তা আনন্দে লয় হয়। যখন তুমি চিন্তারত, যখন তোমার কোন দেহজ্ঞান থাকে না, তখন তুমি কোথায় অবস্থান কর? তখন তুমি দেহের বাহিরে, মনের বাহিরে বর্ত্তমান এবং উহাই আনন্দাবস্থা। আনন্দই তোমার প্রকৃতস্বরূপ, সেইজন্য তুমি আনন্দ ভালবাস। মানুষ সর্ব্বদা সুখের জন্য অস্থির – অস্থির, কারণ কোনও না কোনও দুঃখ তাহাকে কষ্ট দিতেছে। মানুষ অবিরত আনন্দ অন্বেষন করিতেছে এবং সে কেবল তাহার নষ্ট আনন্দ পুনরায় লাভ করিবার জন্যই গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ও দেশ হইতে দেশান্তরে ছুটিয়া বেড়ায়। আনন্দের জন্য এই অন্বেষণ ও ভগবদন্বেষণ একই; কারণ ভগবাণ্‌ ও আনন্দ অভিন্ন ও একার্থবোধক। সেই জন্যই বলা হয় “মূর্খে বলে তাহার অন্তরে ভগবাণ্‌ নাই; কারণ ভগবাণ্‌ হইতেই সমস্ত সুখের উদ্ভব, যে কেহ সুখ অন্বেষন করে সে তাঁহাকেই অন্বেষন করে। আনন্দই আমাদের ভগবৎসংজ্ঞা। এমন কোন নাস্তিক নাই যে আনন্দ চায় না, সেই আনন্দই ভগবান। আনন্দ হইতেই নিখিল সৃষ্টির উদ্ভব, আনন্দেই উহার স্থিতি এবং আনন্দেই উহার বিলয়। ভগবাণ্‌ হইতে আমরা ও সমগ্রবিশ্ব উদ্ভূত; আমরা তাঁহাতেই অবস্থান করিতেছি, আবার তাঁহাতেই ফিরিয়া যাইব।“ সুতরাং আনন্দ ও ভগবাণ্‌ একই। অতএব কেহই বলিতে পারে না যে সে নাস্তিক; কারণ প্রত্যেকেই আনন্দে বিশ্বাস করে, আর সেই আনন্দইত ভগবাণ্‌! বাস্তবিক প্রত্যেক মনুষ্যই সুখ খুঁজিতেছে। কোন্‌ সুখ তুমি চাও? – সে সুখের কদাপি বিরাম নাই। তুমি তৃপ্তি চাও সেইজন্য এই ক্ষণিক পার্থিব সুখ গ্রহণ করিতে চাও, কারণ উহা তোমাকে কিঞ্চিৎ তৃপ্তিদান করে; কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন সুখই তোমার আদর্শ।

যে আনন্দের বিরাম নাই তাহাই ভগবান নামে অভিহিত, আর যে সুখের অন্ত আছে তাহার নাম ইন্দ্রিয়সুখ। তোমার ক্ষণিক তৃপ্তি বিধানে সমর্থ এই সসীম সুখে তুমি ক্ষণকালের জন্য তুষ্ট হইতে পার, কিন্তু অক্ষয় নিরবচ্ছিন্ন আনন্দই তোমার আদর্শ। উহা তোমাকে অনুভব করিতে হইবে। যে ব্যক্তি দ্রুত আহার শেষ করিয়া কর্ম্মস্থানে ছুটিতেছে ও সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করিতেছে সে আনন্দেরই অন্বেষণ করিতেছে। আর ঐ যে ব্যক্তি নির্জ্জনে উপবেশন করিয়া মনঃসংযম করিতেছেন এবং তাঁহার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভুলিবার ও স্বীয় অন্তরে ভগবদ্দর্শনলাভের চেষ্টা করিতেছেন, উনিও সেই আনন্দের জন্যই ব্যাকুল।

এক্ষণে ঐ প্রণালী দুইটী বিচার করিয়া দেখা যাউক। প্রথমোক্ত ব্যক্তি প্রকৃত পক্ষে অর্থের জন্য ব্যগ্র কারণ উহা তাহাকে ও তাহার পরিবারবর্গকে আহার, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ প্রদান করিবে। অতএব সে অর্থ ও শক্তি অর্জ্জনের চেষ্টা করে। সে ভাবে যে শক্তির সাহায্যে সে প্রকৃতিকে তাহার সকল অভাব পূরণ করিবার জন্য বাধ্য করিবে। কিন্তু ঐ প্রণালী অতি অনিশ্চিত। সে অর্থলাভ করিতে পারে কিন্তু তদুৎপন্ন আহার বা স্বাচ্ছন্দ্য সে জীর্ণ বা উপভোগ করিতে সমর্থ নাও হইতে পারে। আমি কলিকাতার এক লক্ষপতিকে জানিতাম। তিনি মাত্র বার্লি-জল পরিপাক করিতে পারিতেন। সুতরাং ভোগ হিসাবে তাঁহার হীনতম ভৃত্যের তুল্যও তিনি ভাগ্যবান ছিলেন না। তাহার পর অর্থ থাকিলেই বা ঐ ব্যক্তি কতকাল তাহা ভোগ করিতে সমর্থ হইবে? – কেবল যতদিন তাহার দেহ থাকে। আমরা সকলেই জানি যে পৃথিবীতে জীবনের ন্যায় অনিশ্চিৎ আর কিছুই নাই। দোলনার শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, ধনী, দরিদ্র সকলেরই নিকট যে কোন মুহূর্ত্তে মৃত্যু আসিতে পারে। যখন আমরা আপনাদিগকে দেহ হইতে অভিন্ন জ্ঞানে মনে করি যে দেহ বা মনের সন্তোষ আমাদের প্রকৃত সন্তোষ, তখন আমরা বুঝিতে পারি সুখ কিরূপ ক্ষয়শীল।

প্রত্যেক ব্যক্তিই ষড়বিধ বিকারের অধীন। গর্ভে শিশু ছিল, তাই শিশুর আবির্ভাব। যখন তাহার জন্ম হইয়াছে তখন অবশ্যই তাহার আকার বৃদ্ধি ও সর্ব্বপ্রকারে পরিবর্ত্তন হইবে। সে ক্রমে বালক, যুবা ও বৃদ্ধ হইবে। তারপর? – ক্রমশঃ ক্ষয়। চক্ষুদ্বয় শক্তিহীন হইবে, কর্ণদ্বয় আর শুনিবে না, হস্তপদ নিস্ক্রিয় ও স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হইবে।

ইহাই প্রত্যেক প্রাণীর জীবনেতিহাস। যে জীব এরূপ দেহবদ্ধ, যাহার মন সংশয়পূর্ণ সে কিরূপে অনন্ত জীবন আশা করিতে পারে?

তথাপি কেহই মরিতে চায় না। মানুষের নিকট মৃত্যুর ন্যায় ঘৃণ্য আর কিছুই নাই। অতএব এই বর্ত্তমান জীবনই যদি আমাদের একমাত্র জীবন হয়, তাহা হইলে মানুষ ত মৃত্যুর হস্ত হইতে কখনই নিস্তার পাইবে না, সুতরাং সে ত সুখী হইবার আশা করিতে পারে না! কিন্তু জীবনের সংজ্ঞা কি? জীবন অর্থে অস্তিত্ব বা সত্ত্বা এবং মৃত্যু অর্থে অনস্তিত্ব বা অসত্ত্বা বুঝায়। আমরা কিন্তু জানি যে অস্তিত্ব হইতে অনস্তিত্বের উদ্ভব অসম্ভব, যাহা সৎ তাহা অসৎ হইতে পারে না। সুতরাং জীবন কখনও মৃত্যুরূপে বা মৃত্যু কখনও জীবনরূপে পরিবর্ত্তিত বা বিকার প্রাপ্ত হইতে পারে না। অতএব মানুষ যখন জীবন-বিশিষ্ট তখন সে মরিতে পারে না। কিন্তু যে জীবন কখনও মৃত্যু-রূপ বিকারপ্রাপ্ত হইবে না, সে জীবন মানুষ কোথায় পাইতে পারে? – সে জীবনের সন্ধানে তাহাকে দেহ অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে এবং যদি সে দেহের অতীতে যাইতে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় হইতে পারে তবে সে অবশ্যই সমগ্রবিশ্বের অতীত হইবে, কারণ, তোমার এই ক্ষণভঙ্গুর আকারেও সমগ্রবিশ্বের অস্তিত্ব বর্ত্তমান। তোমার নয়নে সমস্ত রূপজগৎ, শ্রবণে সমস্ত শব্দজগৎ এবং রসনায় সমগ্র রসজগৎ অবস্থিত।

নিদ্রা ব্যাপারটী হইতে উহা সহজেই প্রমাণিত হয়। যতক্ষন চক্ষুদ্বয় দর্শন করে ততক্ষণ তোমার নিক্ট রূপের অস্তিত্ব, যতক্ষণ নাসিকা অঘ্রাণ লয়, ততক্ষণ তোমার নিক্ট গন্ধের অস্তিত্ব, যতক্ষণ কর্ণদ্বয় শ্রবণ করে ততক্ষণ শব্দের অস্তিত্ব; প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের পক্ষেই এইরূপ। যখন তুমি তোমার চক্ষু কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অবস্থিত তখন তোমার জাগ্রতাবস্থা। তারপর একটী চিন্তাময়ী অবস্থা আছে, তখন তুমি মনোমধ্যে অবস্থিত। কিন্তু আরও একটী অবস্থা আছে – যখন তুমি ইন্দ্রিয়গণের বাহিরে ও মনোরাজ্যের বাহিরে চলিয়া যাও সেই অবস্থার নামই সুষুপ্তি। তখন কোন বন্ধু তোমার পার্শ্বে বসিয়া মধুর স্বরে সঙ্গীত করিলেও তুমি তাহা শুনিতে পাইবে না, কারণ তুমি তখন তোমার কর্ণে আবস্থিত নও। তুমি তোমার দেহে বর্ত্তমান বটে কিন্তু কর্ণ বা অন্য কোন ইন্দ্রিয়ের সহিত তোমার সংযোগ নাই। তুমি কিন্তু সে সময়য় মন বা ইন্দ্রিয়গুলির অতীত হইলেও দেহের মধ্যেই অবস্থিত, কারণ তখন তোমায় সজোরে আঘাত করিলে তুমি জাগ্রত হও। এই জাগরণের অর্থ কি? – ইহার অর্থ, মনে বা ইন্দ্রিয়ে তোমার প্রত্যাবর্ত্তন। যখন তুমি নিদ্রিত ছিলে তোমার স্ত্রী তোমার পার্শ্ব ছিল, কিন্তু তুমি তাহা জানিতে পার নাই। তোমার চতুর্দ্দিকস্থ সমগ্র বস্তু ও নিখিল বিশ্বের সহিতও তোমার ঠিক ঐভাব হইয়াছিল। অতএব বিশ্বের অস্তিত্ব এই মন ও ইন্দ্রিয়গ্রামে তোমার অবস্থিতির উপরই নির্ভর করিতেছে। যখন তুমি নিদ্রিতছিলে তখন কি তোমার নিক্ট কোন বিশ্বের বা তাহার স্মৃতির অস্তিত্ব ছিল? না। সুতরাং এই দেহ নিঃসন্দেহরূপে ক্ষণ-ভঙ্গুর হইলেও ইহাই সমগ্র বিশ্বের অবলম্বন। সেই জন্য বিস্বাতীত হইতে হইলে আমাদিগকে মন ও ইন্দ্রিয় অতিক্রম করিতে হইবে। তাহা হইলেই অনন্তজীবন প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই ভাবেই তোমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ তাঁহাদের অনন্ত স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছিলেন। এজন্য তাঁহাদিগকে বরিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় মনকে অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। তুমি যদি তাহা করিতে পার তবে তৎক্ষণাৎ অনন্ত-জীবন উপলব্ধি করিবে এবং বিশুদ্ধ কেব্লানন্দের অধিকারী হইবে – ইহাই মোক্ষ।

অতএব দেখা যাইতেছে যে, একটী উপায় তোমাদিগকে বিপথে এবং অপরটী গন্তব্যস্থানে লইয়া যায়। অর্থোপার্জ্জনরূপ যে উপায়টী একমাত্র এই দেহ দেবতারি সেবা ও পূজা করিতেছে। এবং এই দেবতাকে পূজা কর বলিয়াই তোমরা তোমাদের স্ত্রী, উত্তম খাদ্য, সুন্দর দৃশ্য ও মধুর শব্দ প্রভৃতি ভালবাস। আর তোমরা কোন প্রভুর সেবা করিলে পারিশ্রমিক আশা করিয়া থাক। কিন্তু এই দেহ দেবতার সেবা করিয়া কি পাও? – যাহা তোমরা অত্যন্ত ঘৃণা কর – সেই মৃত্যুতেই উহা তোমাদিগকে লইয়া যায়। বহুজন্ম ধরিয়া তোমরা এই দেবতার সেবা করিতেছ আর প্রত্যেকবার মৃত্যুরূপ পুরস্কার লাভ করিয়াছে। অতএব ইহা নিশ্চয়ই ঠিক সেবা নহে। যদি প্রকৃত পুরস্কারের জন্য যথার্থ সেবা করিতে চাও তবে সত্য দেবতার সেবা কর। তাহা হইলে অনন্তজীবন পাইবে।

সেবার পথ অন্তর্মুখী, বহির্মুখী নহে। অন্তর্গামী কর্ম্মশক্তি সমূহের অনুওশীলন বা নিয়োগই অনন্তজীবন উপলব্ধি করিবার উপায়। তোমাকে তোমার সমস্ত শক্তি একত্রিত করিয়া অন্তর্মুখী করিতে হইবে। তাহা না পারিলে তুমি নীচ পশু অপেক্ষা শ্রেষ্ট নহ। প্রকৃত জীবন অন্তরে – বাহিরে নহে। কিন্তু তাহা লাভ করিতে হইলে তোমায় কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে। কত জন্ম তুমি এই দেহ দেবতার সেবা করিতেছ, হঠাৎ প্রকৃত দেবতার পূজা আরম্ভ করা সহজ নহে। নিজের মনজয় করা অপেক্ষা সমগ্র পৃথিবী জয় করা সহজ। সেই জন্যই অর্জ্জুনের ন্যায় মহা-যোদ্ধাকে স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে, তিনি বহুরাজ্য জয় করিলেও স্বীয় মন জয় করিতে অক্ষম। - কেন? অর্জ্জুন যে বীর ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই বিসেষ ক্ষেত্রে কখনও কার্য্য করেন নাই বলিয়া নিজেকে অক্ষম ভাবিয়াছিলেন। আমরাও এবিষয়ে অর্জ্জুনের তুল্য। কিন্তু এই জীবনে তোমার অনন্ত স্বরূপ উপলব্ধি করিতে হইলে তোমাকে এই পথই অবলম্বন করিতে হইবে – “নান্য পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।”

অতএব দেখিতেছি যে, সর্ব্বাপেক্ষা সুখী ধনী ও ক্ষমতাশালী হইবার উপায় স্থিরীকৃত হইয়াছে। এখন কিসের প্রয়োজন? – ইচ্ছা। যদি এই পথ অনুসরণ করিবার ইচ্ছা না থাকে তবে ইহা জানা বৃথা। কিরূপে সর্ব্বোৎকৃষ্ট খাদ্য প্রস্তুত করিতে হয় তাহা তুমি জানিতে পার, কিন্তু যদি পাকশালায় গিয়া তাহা প্রস্তুত না কর তবে তোমার জ্ঞান নিস্ফল। এই অন্তর্বর্ত্তী – কেবলমাত্র সেই জ্ঞানদ্বারা তোমার কোন সাহায্য হইবে না। তোমার বিশেষ চেষ্টা দ্বারা সেই অন্তরে যাইতে হইবে। অতএব ধর্ম্ম জিনিষটী সম্পূর্ণরূপে অনুষ্ঠান মূলক (Practical)। তর্ক বা বিচারের সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ নাই। তোমার নির্দ্দিষ্ট পথটীর অনুসরণেচ্ছা জন্মিবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত উহাদের আবশ্যকতা থাকিতে পারে মাত্র। তুমি অজ্ঞতম হইতে পার, কিন্তু তথাপি যদি তোমার ভগবানের নিক্ট যাইবার প্রবল বাসনা থাকে তবে কোনরীপ বিদ্যা না থাকিলেও তুমি অন্তরে তাঁহার নিকট পৌঁছিতে পার। তখন মহাশিক্ষিত ব্যাক্তিগণও আসিয়া তোমার পাদমূলে উপবেশন করিবেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ প্রায় নিরক্ষর ছিলেন, তথাপি খ্যাতনামা পন্ডিতগণ তাঁহাদের সংশয় দূর করিবার জন্য তাঁহার নিকট আসিতেন। ভগবানকে লাভ করিবার জন্য তাঁহার তীব্র বাসনা ছিল এবং তাঁহাকে লাভ করিয়াছিলেন বলিয়াই তিনি এ বিষয়ে তাঁহাদের সাহায্য করিতে সক্ষম হইতেন। ‘কেবলমাত্র পুস্তক পাঠ ও পরীক্ষায় কৃতকার্য্যতার দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়’ তাঁহার জীবনী এই ধারণাটীর জ্বলন্ত প্রতিবাদ স্বরূপ। জ্ঞান সম্বন্ধে উহা খুবই হীন ধারণা। তোমার জীবনব্যাপী চেষ্টার পরও প্রকৃতপক্ষে তোমার কিছুই জ্ঞান হয় না। সক্রেটিস বিজ্ঞতম ব্যক্তি ছিলেন, কারণ তাঁহার জানা ছিল যে তিনি কিছুই জানিতেন না।

এরূপ মহাপুরুষ যে কেবল নিজে ভগবানকে প্রতক্ষ্য করেন তাহা নহে, অপরকেও প্রতক্ষ্য করাইতে পারেন। স্বামী বিবেকানন্দ বাল্যকালে ক্রমাগত এমন এক ব্যক্তির অন্বেষণ করিতেন যিনি ভগবানকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন বলিতে পারেন। তিনি বলিতেন, প্রত্যক্ষ না করিলে ভগবানের অস্তিত্বে কিরূপে বিশ্বাস করা যায়? যখনই তিনি কোন বড় সাধু বা ধর্ম্মোপদেষ্টার নাম শুনিতেন তখনই তাঁহার নিকট যাইয়া জিজ্ঞাসা করিতে “ভগবান কি আছেন?” উত্তর হইত “হাঁ।” তৎপরে তিনি প্রশ্ন করিতেন “আপনি কি তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন?” এবং “না” উত্তর পাইয়া সেস্থান ত্যাগ করিতেন। ভগবানকে প্রতক্ষ্য করিয়াছেন বলিতে পারেন এমন কোন লোক তিনি কোথাও পান নাই, সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, ভগবান কাল্পনিক বস্তু। তৎপরে একদিন তিনি দক্ষিণেশ্বরের সেই ধর্ম্মগুরু, সেই নিরক্ষর মহাসাধুর নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করেন “আপনি কি ভগবাঙ্কে দেখিয়াছেন?” শ্রীরামকৃষ্ণ দেব বলিলেন “হাঁ।” “আমায় দেখাইতে পারেন?” ভগবান তৎক্ষনাৎ উত্তর করিলেন “পারি।” অবশেষে স্বামিজী তৃপ্ত হন এবং এই জন্যই তিনি তাঁহার সুমস্ত পুস্তকে বারবার বলিয়াছেন যে, ধর্ম্ম অনুভূতির বস্তু। বাস্তবিক, ধর্ম্ম সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধির বিষয়।

ভগবানকে প্রত্যক্ষ করিতে হইবে এবং উহা যথেষ্ট শ্রমসাপেক্ষ। বহুজন্ম ধরিয়া মিথ্যা দেবতার সেবা করিয়া যে সকল সংস্কার রাশি সংগ্রহ করিয়াছ প্রথমে সেগুলিকে দমন করিতে হইবে – মন ও ইন্দ্রিয়গ্রামকে জয় করিতে হইবে। যীশুখৃষ্টের মত এই দেহ ও ইন্দ্রিয়গুলিকে ক্রুশবিদ্ধ করিতে না পারিলে তোমার উন্নতির অর্থাৎ এই নিজীব দেব হইতে নিজেকে উত্থিত করিবার আশা নাই। যদি আপনাকে উন্নত করিতে চাও তবে দেহ ক্রুশবিদ্ধ ও ইন্দ্রিয় জয়। ইহা প্রত্যেককেই করিতে হইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ইহার উৎকৃষ্ট উপায় নির্দ্দেশ করিয়াছেন। তিনি বলেন, ইন্দ্রিয় জয় করিতে চাও ত ভগবানকে পূর্ণতম ও সর্ব্বশ্রেষ্ট জ্ঞান কর। তুমি সৌন্দর্য্যের অনুরাগী কিন্তু ভগবানে যে অনন্ত সৌন্দর্য্য বর্ত্তমান তাহা তুমি কোথায় পাইবে? তুমি বাগ্মিতা-প্রিয় কিন্তু যে ভগবান হইতে সমগ্র বেদের উদ্ভব তাঁহার অপেক্ষা বাগ্মী আর কে আছেন? তুমি শক্তিকামী, কিন্তু ভগবানের ন্যায় শক্তিশালী কে? মনুষ্য মাত্রেই এই গুলির কোনটী ভালবাসে এবং ভগবানে সমস্তগুলই অসীম পরিমাণে বর্ত্তমান। তুমি হয়ত কোন সুন্দরী রমণীকে ভালবাস, তাহার রূপ ত ক্ষণস্থায়ী কিন্তু ভগবানের সৌন্দর্য্য নিত্য। অতএব যদি অক্ষয় সৌন্দর্য্য অবিনশ্বর জীবন, অনন্ত শক্তি ও জ্ঞানলাভ করিতে চাও, তবে ভগবানের নিকট চাও। তাঁহার নিকট যাইতে হইলে অর্থের কোন প্রয়োজন নাই – তোমায় কোন টিকিট কিনিতে হইবে না। তাঁহার নিকট গমন করিবার জন্য তোমার পদের, তাঁহাকে দর্শনের জন্য তোমার চক্ষুর এবং তাঁহার বাণী শ্রবণের জন্য তোমার কর্ণের কোনও প্রয়োজন নাই। তিনি তোমার অন্তরে, - তথায় পৌঁছিতে হইলে তোমায় সকল দ্বাররুদ্ধ করিতে হইবে। তাঁহাকে দেখিতে হইলে তোমার চক্ষু মুদ্রিত, তাঁহার বাণী শুনিতে হইলে কর্ণরুদ্ধ এবং তাঁহার নিকট যাইতে হইলে বাহ্য কর্ম্মশীলতা ত্যাগ করিতে হইবে।

অতএব এই ইঙ্গিত ও নির্দ্দেশ অবলম্বনে স্বীয় অন্তরে প্রবেশ করিয়া ভগবানকে উপলব্ধি কর – তবেই তুমি প্রকৃত মানুষ হইবে। কিন্তু ইহার জন্য চাই তোমার প্রবল ও তীব্র বাসনা। যদি তুমি একবার ভগবানের সহিত তোমার সম্বন্ধ অনুভব করিতে পার, যদি উপলব্ধি করিতে পার যে তিনিই তোমার প্রকৃত পিতামাতা ও অকৃত্রিম বন্ধু ও সহচর, এবং যদি তাঁহার নিকট গমন করিতে পার, তাহা হইলে অনন্তপুরস্কার লাভ করিবে, তোমার যত্ন ও প্রতিপালনের জন্য তিনি এমন কি তোমার ভৃত্যস্বরূপ হইবেন। অতএব যদি বাতুল না হও তাহা হইলে তুমি নিশ্চই তাহাতে মনপ্রাণে অনুরাগী হইবে, কারণ কেবল তাঁহার নিকট হইতেই তুমি পূর্ণ আনন্দ ও পরাজ্ঞান লাভ করিবে।

----------------------------------------------------------------------------

* শ্রী কেশবচন্দ্র নাগ, বি, এ কর্ত্তৃক ইংরাজী হইতে অনুদিত।

----------------------------------------------------------------------------

কৃতজ্ঞতাঃ উদ্ধোধন পত্রিকা, ২৫শ বর্ষ – ৭ম সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৩৩০।

(তৎকালীন বানান অপরিবর্তিত)

bottom of page